জীবন ও কর্ম : প্রসঙ্গ জয়নুল আবেদিন

ক. জীবনতথ্য
১. জন্ম, শৈশব ও শিল্পচৈতন্য : শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) বাংলাদেশের চারুশিল্পান্দোলনের কিংবদন্তি, প্রবাদপ্রতিম পথিকৃৎ। আমাদের সময়ের এক মহান চিত্রশিল্পী। যাঁর শিল্পের মহিমায় সমুজ্জ্বল এদেশের চারুকলার প্রাঙ্গণ। এই মহান শিল্পী বৃহত্তম ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ থানা (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা)’র ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত একটি ছোট্ট পরিসরের সরকারি বাসায় নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি “টুনু” নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। পিতা শেখ তমিজউদ্দিন আহমেদ (১৮৮১-১৯৫৬) ছিলেন কিশোরগঞ্জ সদর থানার সহকারি সাব-ইন্সপেক্টর। মাতা জয়নবুন্নেসা (১৮৯২-১৯৮৭) ছিলেন একজন কর্মনিষ্ঠ গৃহিনী। এই পারিবারিক পরিমণ্ডলে জয়নুলের বেড়ে উঠা। প্রকৃতির কাছে থেকে তিনি পেয়েছেন শিল্পচেতনায় প্রেরণা। কৈশর থেকেই জয়নুলের মধ্যে শিল্প প্রতিভা জন্ম নেয়। তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন, সরল মানুষের জীবনযাত্রা, নদীর কলতান, বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য, পালতোলা নৌকা, গুণটানা, পাখির কলরব এই দৃশ্যমান চিত্রাবলী তাকে সর্বদা আন্দোলিত করে, ছবি আঁকায় মনোনিবেশে প্রণোদনা দেয়। পাঠ্যবই, ক্লাশের খাতায় তাই তিনি এঁকেছেন অঢেল। যা তাঁর শিক্ষক ও সহপাঠীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। এই স্কুল জীবনে ছবি আঁকার প্রতি প্রেরণা জুগিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক চিন্তাহরণ মজুমদার।১
২. প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা, প্রদর্শনী, পুরস্কার ও সম্মাননা : জয়নুল সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ভারতের বম্বে থেকে প্রকাশিত “ইড়সনধু পৎড়সরপষব”পত্রিকা “গলফ খেলা” শীর্ষক এক ফটোগ্রাফির হুবহু পেন্সিল স্কেচের প্রতিযোগিতা আহ্Ÿান করে। শিশুদের মধ্যে ক্ষুদে শিল্পী জয়নুল আবেদিন এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের পুরস্কার অর্জন করে তিনি স্কুলের সকল শিক্ষকদের রীতিমত অবাক করে দেন। শিক্ষকরা অনুধাবন করেন এই জয়নুল একদিন মস্তবড় আঁকিয়ে হবে। ‘জয়নুলের এই পুরস্কার প্রাপ্তির পর শিক্ষক চিন্তাহরণ মজুমদারের পরামর্শে জয়নুলের বাবা তমিজুদ্দীন পুত্রকে আর্ট কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন’।২তবে পারিবারিক টানাপোড়নে এই সিদ্ধান্তে অনেকটা ভাটা পরে। কিন্তু জয়নুল দমেননি। তিনি ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন অবস্থায় বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বন্ধুদের সাথে “কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুল” দেখতে যান। অবশেষে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের মাসিক পনের টাকা জলপানি (বৃত্তি) সম্বল করে জয়নুল কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।৩ কলকাতায় লোকান গার্ডিয়ান হিসেবে দায়িত্ব নেন তৎকালীন প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৯)। এ প্রসঙ্গে শিল্পচার্য বলেন,‘তিনি সহযোগিতা না করলে আমি হয়তো আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে পারতাম না’।৪ স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর জয়নুল অর্থকষ্টে পড়েন। এসময় লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উপক্রম হয়। এ সময় পুত্রের ছবি আঁকার প্রতি প্রগাঢ় আগ্রহ দেখে অবশেষে মমতাময়ী জননী জয়নাবুন্নেসা স্বামীকে না জানিয়ে নিজ  সোনার গহণা বিক্রয় করে আর্ট স্কুলে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ছবি আঁকার পারদর্শিতা দেখে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মুকুল দে (১৮৯৫-১৯৯১) সহ সকল শিক্ষক বিস্মিত হন।
আর্ট স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ অবধি কখনো দ্বিতীয় হননি। ছবি আঁকায় আর্ট স্কুলের কোনো ছাত্রই তাঁর ধারের কাছে ছিলোনা। তিনি ছিলেন চিত্রাংকনে পারদর্শী। তাই সকল শিক্ষকরাই তাঁর অদম্য প্রতিভার ঢের প্রংশসা করতেন। তাঁর এই প্রতিভা দেখে আর্ট স্কুলের অন্যতম প্রখ্যাত শিক্ষক বসন্ত কুমার গাঙ্গুলী বলতেন, ‘আজও আর্ট কলেজে যত ছাত্র এসেছে, জয়নুলের মতো একজনও আসেনি’।৫ জয়নুল ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে, অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। একই বৎসর বহ্মপুত্র নদীর আঁকা জলরঙ চিত্রে সর্বভারতীয় গভর্নর স্বর্ণপদক পুরস্কার অর্জন তাঁকে খ্যাতির সুুউচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়। এবং একই বৎসর ৫ম বছর ছাত্র থাকাবস্থায় স্কুলের শিক্ষকতা করার সুযোগ লাভ করেন। এ সময় শিল্পীসত্তার বিকাশ সাধনে নিজেকে এক অবিস্মরণীয় শিল্পী হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সর্বদা তাঁর শিল্প হৃদয়কে আন্দোলিত করতো। এই শিল্পসাধনার প্রাক্কালে তিনি ১৯৪৬ সালে ঢাকায় তৈয়বউদ্দিন আহমেদ এর তৃতীয় কন্যা জাহানারা আহমেদকে বিয়ে করেন। জয়নুলের চিত্রকর্মে নারী গ্রামীণজীবন চিত্রাবলী স্থান দখল করে বিয়ের পরবর্তী পর্যায় থেকেই। তিনি করাচি থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন। এবং ১লা মার্চে ইনস্টিটিউটে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করে। ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি ইউরোপের ইংল্যান্ড, প্যারিস সহ করেকটি দেশ ভ্রমণ করেন। ফলে এ সময় ইউরোপের শিল্পধারা সম্যক অনেক জ্ঞান অর্জন করতে সমর্থ হন। দেশে ফিরে তিনি দেশীয় লোকজ ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক পশ্চিমা শিল্পধারার সংমিশ্রণে এক নবধারায় শিল্পনির্মাণে মনোনিবেশ করেন।
জয়নুল আবেদিন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে এবং ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে করাচিতে একক চিত্র প্রদর্শনী করেন। তিনি রকফেলার ফাউন্ডেশনের তত্ত¡াবধানে ১৯৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকো,আমেরিকা, ইউরোপের বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তাঁর ৫২টি চিত্রকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকায় ওয়াশিংটন ডিসিতে স্মিথ সোনিয়াল ইনস্টিটিউটে। তিনি ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের আজীবন সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা“প্রিন্সিপাল ডেজিগনেট” হিসাবে যোগদান করেন এবং পাকিস্তান সরকারে তথ্য ও গবেষণা বিভাগের অধীনে প্রধান নকশাবিদ হিসেবে করাচীতে যোগদান করেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ পদক “প্রাইম অব পারফরমেন্স”; সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ পদক “হিলাল-ই-ইমতিয়াজ” নামক বেসামরিক উপাধি লাভ করেন। সোভিয়েত সরকার কর্তৃক সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তেহরানে আরসিডি দেশভিত্তিক চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।৬
৩. চারুশিক্ষার দ্বার উন্মোচনে জয়নুল
আজ থেকে বাহাত্তোর বৎসর পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীন ভূ-খণ্ডের রাজধানী ঢাকায় জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে চারুশিল্পের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিলো। দেশভাগের পূর্বমুহূর্ত ও পরবর্তীমুহূূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) আগত বাঙালি মুসলিম শিল্পীরা প্রথমদিকে নানাবিধ সমস্যার উপনীত হন। তারপরও তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন: জয়নুল আবেদিন ঢাকার “আরমানিটোলা নর্মাল স্কুল”, সফিউদ্দীন আহমেদ () “ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল”, আনোয়ারুল হক () “চট্টগ্রাম নর্মাল স্কুল”, শফিকুল আমিন() “ময়মনসিংহ টিটার্স ট্রেনিং স্কুল” এবং সৈয়দ আলী আহসান() ও শেখ আনোয়ার() “আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল”-এ ড্রইং শি¶ক হিসেবে যোগদান করেন। এবং ঐসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত থাকাবস্থায় শিল্পীরা “আর্ট স্কুল” প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিশেষত জয়নুল আবেদিন চারুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্নে সবর্দা ছিলেন উদ্বেলিত। এ সময় প্রধান ডিপিআই ছিলেন বৈজ্ঞানিক ড. মোহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা ()’র সঙ্গে “আর্ট স্কুল” প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ ও কামরুল হাসান () সাক্ষাৎ করেন। তিনি “আর্ট স্কুল” গড়ার পক্ষে আগ্রহ প্রকাশ করলেও সরকারি উচ্চ মহলের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ব্যাহত হয়। কিন্তু জয়নুল আবেদিন দৃঢ় মনোচিত্তে এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

জয়নুল ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিব উল্লাহ বাহারের সঙ্গে সা¶াৎ করে “আর্ট স্কুল” প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। একই সময়ে জয়নুল আবেদিন “আর্ট স্কুল” প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইউনেস্কোর প্রধানের সাথে দেখা করে তাঁর মুদ্রিত জীবনপঞ্জিসহ পোস্টকার্ড আকৃতির দুর্ভি¶ চিত্রের কিছু আলোকচিত্র তাঁকে প্রদান করেন এবং আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কথা বলেন। অবশেষে পাকিস্তান সরকারের এই বৈরী মনোভব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শেষাবধি তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রোটারি সলিমূল্লাহ ফাহমীর একান্ত সহযোগিতায় ঢাকার নবাবপুরের জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের পূর্ব পার্শ্বে হাসপাতাল সংলগ্ন অংশের নীচতলায় জীর্ণ কুটিরের দুটি ক¶ বরাদ্দের ব্যবস্থা হয়। এই বরাদ্দকৃত কক্ষেই ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর ১৭/১৮ জন শিক্ষর্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাশ শুরু হয়। এই প্রারম্ভিক ক্লাশ সূচনার মাধ্যমেই বস্তুত বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শি¶ার দ্বার উন্মোচিত হয়। এই নতুন “আর্ট স্কুল”-এর নামকরণ করা হয়, “গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস” (এড়াবৎহসবহঃ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ অৎঃং)। আর্ট ইনস্টিটিউটের শি¶াক্রমকে পূর্ণাঙ্গ রূপদানের ল¶ে এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান আরোহণের জন্যে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে জয়নুল আবেদিন সরকারি বৃত্তি লাভ করে লন্ডন গমন করেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে অবশেষে রমনার শাহবাগস্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্থায়ীভাবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ইফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব নূরুল আমীন অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে “গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট”-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।৭ ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে জয়নুল আবেদিন এই ইনস্টিটিটের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বস্তুত জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এই চারুকলা অনুষদের শিল্পচর্চাকে কেন্দ্র করেই ক্রমেই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে।
৪. জয়নুল সংগ্রহশালা ও লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা
আধুনিক চারুকলা চর্চার জনক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে ময়মনসিংহ ব্রহ্মপুত্রনদের তীরে “জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা” প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিলে। উদ্বোধন করেন তৎকালীন মহামান্য উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৬ জন সদস্য ও জেলা প্রশাসক সমš^য়ে একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে জেলাপ্রশাসককে সভাপতি করে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। অবশেষে স্ট্রাস্টি বোর্ডের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অধীনে একটি শাখা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। সংগ্রহশালায় সর্বমোট ৬০টি চিত্রকর্ম রয়েছে। এছাড়া শিল্পীর ব্যবহার্য জিনিপত্রের মধ্যে ৬০টি নিদর্শন দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করা হয়েছে। দেশজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য সংগ্রহের উদ্যোগে শিল্পী জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁ’য় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে “বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর” প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার কর্মজীবী পটুয়া,অবহেলিত কারুশিল্পীদের কারিগরি দক্ষতায় পরীশীলিত করা এবং তাঁদের শিল্পসম্ভার সংরক্ষণ করা তাঁর শিল্পীমানসের একটি বহিঃপ্রকাশ।
খ. উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের বিশ্লেষণ
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জীবনের প্রতিমুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে চারুকলার পরিমণ্ডলকে শানিত করেছেন এবং একই সাথে নিজ¯^ শিল্পচেতনায় লালিত সৌন্দর্যবোধকে তাঁর প্রতিটি চিত্রকর্মে বাস্তব, অবাস্তব ও আধুনিক শিল্পধারায় বিকাশিত করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের বিশ্লেষণপূর্বক অবতারণার মাধ্যমে আমরা তা অনুধাবনে সমর্থ হবো। শিল্পী জয়নুলের চিত্রসম্ভারকে কয়েকটি পর্বে বিভাজন করা যায়। যেমন: প্রকৃতিধর্মী, মানবদেহাবয়বধর্মী, পশু-প্রাণী ও গ্রামীণজীবন সম্বলিত চিত্র উল্লেখযোগ্য। তিনি বাস্তবধর্মী, লোকজধারা এবং কালি-তুলির বলিষ্ঠ মোটা রেখাপ্রধান বৈশিষ্ট্যে চিত্র অংকনে বেশি ¯^াচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাঁর চিত্রভাণ্ডারের বিশাল একটা অংশ দখল করে আছে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের বাস্তব চিত্রবলয়ে।
১. প্রকৃতিধর্মী চিত্রবলয়
নদী, পাহাড়, বৃক্ষরাজির এক শ্যামল ভূমি এই বাংলাদেশের প্রকৃতি জয়নুলের শিল্পীসত্তাকে সর্বদা আন্দোলিত করতো। প্রকৃতির এই অনাবিল সৌন্দর্যবোধে নিমগ্ন্র থাকতেন শিল্পী। এই সৌন্দর্যকে বাস্তবরূপে চিত্রপটে অবলীলায় তোলে ধরেন জয়নুল। পেন্সিলে, কালি-কলম কখনো জলরঙ ও তৈলরঙে। বাস্তবরূপে চিত্র উদ্ভাসনে তাঁর বিরাম নেই। তাই একের পর এক ভূ-প্রকৃতির দৃশ্য চিত্রপটে এঁকেছেন। কালিকলমে আঁকা তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য স্কেচ হলো “শ¤ু¢গঞ্জের কাছে বহ্মপুত্রের নদী” (অক্টোবর ১৯৩৩)। ছাত্রজীবনের প্রথম পর্যায়ের কাজ এটি। বহ্মপুত্র নদের পাড়ের দৃশ্য এটি। নদীর ওপারে বিস্তর গ্রাম, কুঁড়েঘর, নানা প্রজাতির গাছের অবয়ব এতে দৃশ্যমান। এছাড়াও তিনি বৃহ্মপুত্রনদী ঘেরা প্রকৃতির বাস্তবরূপ কালিম তুলি এবং জলরঙে অঙ্কন করেছেন। জলরঙে আঁকা জয়নুলের উল্লেখযোগ্য বাস্তবচিত্রের মধ্যে “গাঁয়ের ধারে”,“দূর পাহাড়ের কাছ” অন্যতম। তাঁর জলরঙ চিত্রে গ্রামীণ পরিবেশের দৈনন্দিন চালচিত্র, নদী, উঁচু-নীচু পাহাড় অসমতল রাঢ়ভূমির পটভূমি চিত্রায়িতকরণে জলধৌত ¯^চ্ছ রঙ প্রয়োগে কারিগরি দক্ষতার যথেষ্ট নিদর্শন রয়েছে। গাঁয়ের ছায়াঘেরামাঠ-প্রান্তরে রাখাল বালকের গরু চড়ানোর বাস্তবচিত্রও তাঁর রঙতুলির আঁচড়ে প্রাণ পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক লীলাভূমির অবারিতসৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর পাবর্ত্য চট্টগ্রামের “নৈসর্গিক দৃশ্য”বলয়ে।
২. পশু-প্রাণীর চিত্রসম্ভার
জলরঙ ও নলখাগরার কলম দিয়ে শিল্পী জয়নুল ছাত্রাবস্থায় এঁকেছেন বেশকিছু পশু ও প্রাণীর বাস্তবধর্মী চিত্র। যাতে অ্যাকাডেমিক ধাঁচের যথেষ্ট প্রয়োগ লক্ষণীয়। যেমন উল্লেখ করা যায়,“চিড়িয়াখানা অনুশীল”, “ড্রইং”। এই চিত্রগুলো সম্ভাবত ১৯৩৩ বা ৩৫ খ্রিস্টাব্দে কালি ও তুলির ওয়াশে এঁকেছেন। “চিড়িয়াখানা অনুশীলন” চিত্রটিতে বন্যগরুর অবয়বটি বলিষ্ঠ ড্রইংয়ে লক্ষণীয় মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়েছে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কালি ও কলমে “মোষের বাচ্চা” শীর্ষক চিত্রটি সুকৌশলে অংকন করেন বাস্তবরূপে। খুঁটির সঙ্গে দঁড়িতে বাঁধা মোষের বাচ্চা, শীতের কোনো এক সকালে এটি এঁকেছেন শিল্পী। মোষের গায়ে ছালার চট বা মোটা কাপড়ের আবরণ দেখা যায়। শীতে জড়োসরো হলেও দেহাবয়বে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। আবহমান বাংলার চালচিত্রে গরু, ষাঁড়, মহিষ মাঠ-প্রান্তরে চড়ে বেড়ায়। “ফেরা” (জররঙ, ১৯৭১) নামক চিত্রে একদল গরু বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। তাদের দেহাবয়বে গতি সঞ্চার হয়েছে। “ঝড়ের মধ্যে”( ১৯৭২) চিত্রে প্রবল ঝড়ের মধ্যে পরে গরুরপাল গন্তব্যে ছুটছে। কালি, তুলি ও মোমের মিশ্র প্রক্রিয়ায় চিত্রটি শিল্পী নির্মাণ করেছেন, যাতে কালো রঙের ওয়াশে মোমের আঁচড়ের সাদা রেখাগুলো বলিষ্ঠতা ও গতিময়তায় প্রকাশ পেয়েছে।
৩. গ্রামীণজীবনভিত্তিক চিত্রসমূহ
শিল্পাচার্য জয়নুল গ্রামীণজীবনযাত্রার সাধারণ মানব-মানবীর বাস্তব চিত্রই বেশি এঁকেছেন। কালি, তুলি ও মোম; তৈলরঙ, জলরঙ, কালি ও তুলিপ্রকরণে এসব চিত্রাংকনে পারদর্শীতা দেখিয়েছেন। মানুষের বিভিন্ন রূপাংকনে তাঁর ¯^কীয় বৈশিষ্ট্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা “ফসল মাড়াই”,“চেয়ারে পাঠরতা মেয়ে”, “শরণার্থী”, “সংগ্রাম”, “সাঁওতাল রমণী” উল্লেখযোগ্য।“বিদ্রোহ গরু”(কালি ও তুলি) শীর্ষক চিত্রটিতে খুঁটির সাথে বাঁধা দঁড়িকে ছিড়তে নিজেকে প্রবল ক্ষিপ্রতার সাথে সম্মুকপানে ছুটছে গরুটি। শিল্পী তুলি চালিয়েছেন এমনভাবে যাতে মোটা ব্রাশিং-এ রেখা ক্ষিপ্রতায় দৃশ্যমান হয়েছে। “সংগ্রাম’ (১৯৫৪, টেম্পারা) চিত্রটি একটি প্রকৃত জীবন সংগ্রামের প্রতীকী বাস্তবরূপ। কাঠের গুড়িসমেত ও গরুরগাড়িটি কাদায় আটকে গেছে অথবা নীচু অংশ থেকে উপরে উঠার জন্য শ্রমিক শরীরে সমস্ত শক্তি প্রয়োগে চাকাকে ধাক্কা দিচ্ছে সম্মুখের দিকে এগুতে এবং একই সাথে দুটি গরুর দেহাবয়বেও একই প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। পশু ও মানবের এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সহমর্মিতার ফসল, বর্তমানে আমাদের পিছিয়ে যাওয়া সমাজকে অগ্রসরমান হওয়ার প্রতীকী চিত্র এটি নিঃসন্দেহে। “ফসল মাড়াই” (তৈলরঙ, ১৯৩৮) চিত্রে অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামে-গঞ্জে ধানমাড়াইয়ে ব্যস্ত থাকেন গ্রামের সহজ-সরল মানুষজন। কেউ ধান মাড়ায়ে ব্যস্ত, কেউ গোলায় ধান ভরছে, কেউ বস্তায় ধান ভরছে, কেউ কুলাতে ধান ঝাড়ছে। বাস্তবতার এই চরম জীবনছবি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী জয়নুল।
সাওতাঁল জীবনযাত্রা : পঞ্চাশ দশকের দিকে শিল্পী রোমান্টিক ভাবনায় উজ্জীবিত হন। এ সময় সাঁওতাল পরগণার রাঢ় অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের চালচিত্র ক্যানভাসে ও কাগজপটে তৈলরঙ ও জলরঙে পরিস্ফুট করেন। এ সময়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রের মধ্যে “পাহাড়ী মেয়ে” (১৯৫৫, ক্রেয়ন), “সাঁওতাল নারী ও পুরুষেরা” (জলরঙ ওয়াশ) “সাঁওতাল দম্পতি” (জলরঙ, ১৯৫১), “মাছধরা শেষে ”(১৯৫০, জলরঙ), “সাঁওতাল রমণী“,“ময়ূরাক্ষী (জলরঙ, ১৯৫১), “সাঁওতাল মেয়ে” (তৈলরঙ) উল্লেখযোগ্য। এসব চিত্রবলয়ে সাঁওতালদের সাধারণ জীবন-যাপনের কর্মময়, আনন্দ-বেদনার সুরধ্বনি প্রকাশ পেয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্যে।
নবান্ন উৎসব : গ্রাম-পল্লীর একটি চিরাচরিত উৎসব হলো “নবান্ন”। এটি সাধারণত বাংলা বছরের কার্ত্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে উদ্যাপন হয়ে থাকে। এ সময় ধানকাটা, ধানভানা. ধানমাড়াই, বিয়ে-সাদি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। রীতিমত গ্রাম-প্রকৃতিতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। গায়ের বধূ, গ্রাম্যবালা, আত্মীয়-¯^জনের বাড়িতে আগন্তক অতিথি নানা রঙের পোষাকে নিজেদেরকে পরিপাটি করে রাখেন। নানা ধরনের নকশি পিঠা-পুলি বানানো এবং বিয়ের ধুম লেগে যায় ঘরে ঘরেÑএরূপটি শিল্পী জয়নুল ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অবারিত নবান্নের চিত্রবলয়ে। তাঁর এরূপ একটি স্ক্রল চিত্র হলো “নবান্ন-১”। এটি সাতখণ্ডে পরস্পর সন্নিবেশিত। আয়তন ৬৫ ফুট এবং চওড়া ৫ ফুট। আয়তকার ধরনের চিত্রটিতে বাঁশ ও শাড়ির কাপড়ে মোড়ানো পালকিতে নববধূ ও বরের যাত্রা, গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষকের কাজের সন্ধানে শহরমুখী পথযাত্রা, ধানভানা, ধানমাড়াই, ধানকাটা, ধানকেটে কাঁথে ও মাথায় ধানগাছের বোঝা নেওয়ার অপরূপ বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। চিত্রটি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে জলরঙ, কালি ও তুলিতে রেখাপ্রধান বৈশিষ্ট্যে সুদক্ষতায় জয়নুল কাগজপটে অংকন করেছেন। যাতে গ্রাম-বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি বিকশিত হয়েছে।
পশ্চিমা আধুনিকধাঁচে অংকনকৃত গ্রামীণ নারী : জয়নুল পঞ্চাশের দশকে লোকজ পুতুলের সাথে পশ্চিমা আধুনিক শিল্পরীতির সংমিশ্রণে চিত্র নির্মাণে নিবিষ্ঠ হন। গ্রাম-গঞ্জে লোকায়েত সাধারণ কারুশিল্পীদের তৈরি মাটির টেপা পুতুলের আদলে তাঁর চিত্র আঙ্গিক গড়ে ওঠে। জ্যামিতিক রেখাপ্রয়োগে, লোকজ পুতুল ফর্মে তাঁর চিত্রকর্মে এক নবধারা সূচিত হয়েছে। গ্রামের সাধারণ পরিবাবের দৈনন্দিক নারীর নানা কর্মকাণ্ডের চরিত্র তিনি আকীর্ণ করেছেন নানান রঙের ব্যঞ্জনায়। জলরঙ ও তৈলরঙে চিত্রগুলো তিনি কারিগরি দক্ষতায় রচনা করেছেন। এ পর্বের কাজের মধ্যে “কলসি কাঁখে রমণী”(জলরঙ), “পাইনার মা”(গোয়াশ, ১৯৫৩), “নারীমুখ” (গোয়াশ, ১৯৫১), “বধূ ও আয়না”(কাগজে তৈলরঙ), “বেদেনি”(জলরঙ, ১৯৫৩), “মা ও শিশু-১”(জলরঙ), “মা ও শিশু-২”(জলরঙ), “কেশবিন্যাসরত নারী” (কাগজের ওপর তৈলরঙ), “দুইজন রমণী”(গোয়াশ), “¯œানরতা” (ক্যানভাসে তৈররঙ) উল্লেখযোগ্য। এসব চিত্রে গ্রামীণ সমাজের নারীদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার আলেখ্য উদ্ভাসিত হয়েছে। লাল, কালো, খয়েরি, বাদামি, হালকা হলুদ, হালকা বেগুনি বর্ণলেপনে বৈচিত্র্যময় রেখার সারল্য প্রয়োগে এক অনবদ্য চিত্রের সারাৎসার রচিত, যা আমাদের শিল্পবোধকেএক নান্দনিক অনুভূতিতে সঞ্চারিত করে।
৪. দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা
ক্ষীপ্র তুলির রেখার বাহুল্য প্রয়োগ আর মানবতার এক শিল্পীসত্তা বিকশিত হয়েছে জয়নুলের ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালায়। ভারতবর্ষের কলকাতা শহরে খাবারের অšে^ষণে বিক্ষুদ্ধ জনবসতি, অন্নহীন মানবমুখ, বস্ত্রহীন মানবকুল, রাস্তায় পাশের ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খাদ্যের খোঁজে মানব-মানবী, একই সঙ্গে ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খাবার খাচ্ছে মানুষ, কুকুর আর কাক। এই অমানবিক করুণ দৃশ্যাবলী তরুণ জয়নুলের কোমল হৃদয়কে ব্যথিত করে তুলে। এক মানবতাবোধ জাগ্রত হয় তাঁর শিল্পীসত্তায়। এই বাস্তব চিত্ররূপ ¯^চক্ষে অবলোকন করেছেন শিল্পী। মš^ন্তরের এই দুর্বিসহ জীবনপ্রবাহের দুর্দান্ত দৃশ্য তুলির বলিষ্ঠ রেখায় কালি ও তুলিতে ফুটিয়ে তুলেন বাদামি বা বাঁশপাতার সাধারণ কাগজপটে। এই দুর্ভিক্ষের অমানবিক চিত্রাবলী বিশ্ববাসীর কোমল অনুভূতিকে নাড়া দেয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি বিশ্বশিল্পাঙ্গনে একজন মানবদরদী, মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ক্ষুধার্তপীড়িত শীর্ণদেহী মা ও শিশু ঘুমে কাতর। শহরের রাস্তার পাশে ফুটপাতের মৃতপ্রায় শায়িত না খাওয়া মানুষজন, বিবস্ত্র মানুষের হাহাকার, ক্ষুধার্ত মা ক্ষুধার্ত অবুঝ শিশুকেদুগ্ধদান করতে পারছে না, কংকালসার মানবদেহাবয়বের এসব চিত্র শিল্পী শুধু তুলি ও কালির জাদুকরী আঁচড়ে উদ্ভাসিত করেছেন। এই সব স্কেচকে অবলম্বন করে তিনি পরবর্তীকালে ড্রাইপয়েন্ট ও লিনোকাট প্রয়োগে বেশকিছু চিত্র ছাপাই করেন।

৫. জয়নুলের শেষ জীবনের চিত্রাবলী
সত্তরের দশকের প্রথমদিকে ও অসুস্থ্য অবস্থায় তিনি বেশকিছু চিত্র অংকন করেন। এ সময়ে তৈলরঙে আঁকা তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হলো “বেদে নৌকা” (১৯৭০)। দীর্ঘ আয়তনের চিত্রে নদীর ধারে সারিবদ্ধ নৌকায় বেদে পরিবারের জীবনযাত্রার বাস্তবরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। জয়নুল আবেদিন একজন মানবতাবাদী শিল্পী। তিনি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে গাজা উপত্যকার অধিবাসী ফিলিস্তিনী মুসলিমদের উপর ইসরাইলী বাহিনীর অমানবিক নির্যাতন ও যুদ্ধের বিভর্ষ চিত্র কালি ও তুলির ওয়াশে বাস্তবরূপে অংকন করেছেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে পিতা ও সন্তানের নিথর দেহাবয়ব এবং যুদ্ধে আহত শরণার্থীদের করুণ দৃশ্য তাঁর রঙতুলির বলিষ্ঠ প্রয়োগে বৈচিত্র্যময় রেখায় উদ্ভাসিত হয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হলো “ফিলিস্তিনীর যুদ্ধ”(কালি ও ওয়াশ, ১৯৭০), “ফিলিস্তিনীর শরণার্থী”(কালি ও তুলি, ১৯৭০)।
১৯৭০-এ জলোচ্ছ¡াসের করালগ্রাসে মনপুরা : জয়নুল সর্বদা দেশের মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনছবি আঁকতে বেশি ¯^াচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর চট্ট্রগ্রামের সমূদ্রউপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলে প্রলয়ংকারী ঘূূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ¡াসের বিভীষিকাময় “মনপুরা” দ্বীপের বাস্তবরূপ চিত্রাংকনে এগিয়ে আসেন শিল্পী। তিনি কালি, তুলি, মোমকাঠি আর মার্কিং পেনের দক্ষ কৌশলে বিচিত্রগামী রেখারবলয়ে কাগজপটে জলোচ্ছ¡াস ও ঘূর্ণিঝড়ে প্লাবিত মনপুরা দ্বীপের মানুষ, গাছপালা, ঘরবাড়ি, গরু, মহিষ, ছাগল, নানা পশু-প্রাণীর নিথর দেহাবয়বের বিভর্ষ চিত্র রূপায়ণ করেন। মোমের ড্রইংয়ের পর কালির প্রলেভে মৃত দেহাবয়বগুলো সাদা রেখায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এরূপ “মনপুরা” (১৯৭০) স্ক্রল চিত্রটির আয়তন ৩৮ ফুট দীর্ঘ ও প্রস্থ ৫ ফুট। এই বিশাল আয়তনের চিত্রপটে এক সাথে মানুষ, পশু-প্রাণীর সম্মিলনে এক ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে। মৃত দেহাবয়বের পাশেই একজন মাত্র মানুষ জীবিত। লোকটি বসে বসে ভাবছে আবার কখনো এই প্রলয়ংকর জলোচ্ছ¡াসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে সে হয়তো বাঁচবে না।জয়নুলের এরূপ কয়েকটি চিত্র হলো “মনপুরা’৭০”(কালি, ওয়াশ ও মোম, ১৯৭০), “মনপুরা-১” (কালি ও মোম, ১৯৭০), “মনপুরা-২”(কালি, ওয়াশ ও মোম, ১৯৭০) ও “মনপুরা”(মার্কিং পেন, ১৯৭০)।
মুক্তিযোদ্ধার চিত্র : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এদেশকে পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে ¯^াধীন করতে এদেশের জনগণ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে। অনেক তরুণ মুক্তিযুদ্ধে সরারসরি অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের ¯^াধীনতা অর্জিত হয় এবং লাল সবুজের পতাকায় বাংলাদেশ বিশ্বেরমানচিত্রে স্থান দখল করে। এই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে শিল্পী জয়নুল মুক্তিযোদ্ধাদের ¯^তঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বাস্তব চিত্র অংকন করেন। বন্দুক হাতে যুদ্ধে অগ্রসরমান যোদ্ধাদের দেহাবয়বে বীরত্বের ছাপ, দেশ ¯^াধীন না হওয়া পর্যন্ত তাদের আমরণ যুদ্ধ চলবেÑএই প্রত্যয় তাদের মধ্যে লক্ষণীয় এবং একই শিল্পী জয়নুলের মধ্যে যে ¯^াধীনতার চেতনা বিদ্যমানতারও বহিঃপ্রকাশ বলিষ্ঠরেখায় সুচারু বৈশিষ্ট্যে ফুটে উঠেছে। এরূপ কয়েকটি চিত্রের মধ্যে “মুক্তিযোদ্ধা-১”(কালি ও তুলি, ১৯৭১) ও“মুক্তিযোদ্ধা-২”(কালি, কলম ও ওয়াশ, ১৯৭১) অন্যতম।
এ সময়ের কয়েকটি রেখাপ্রধান বাস্তবধর্মী চিত্রের মধ্যে “দুই বেদেনি”(কালি, ওয়াশ ও মোম, ১৯৭২), “দুটি মুখ” (কালি, তুলি ও মোম, ১৯৭৪), “কলসি সঙ্গে নারীগণ” (১৯৭৩)। এছাড়াও তিনি স্টোন লিথোগ্রাফি প্রকরণে বেশকিছু চিত্র ছাপাই করেন এই দশকে। মানবতাবাদী, বাস্তববাদী এই কালোত্তীর্ণ চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন জীবনের শেষ ছবি “দুটি মুখ” তুলিও কালিতে কাগজপটে বিছানায় মৃত্যুশয্যায় অংকন করেন ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে। শিল্পী জয়নুল শিল্পানুরাগী শিল্পবোদ্ধা ও শিল্প-শিক্ষার্থীদের কর্তৃক শিল্পাচার্য উপাধিতে ভূষিত হন ১৯৬৭ খ্রিস্টাাব্দে। বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমির উপদেষ্টা ও দেশের অন্যতম প্রথম জাতীয় অধ্যাপক উপাধি অর্জন করেন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি লিট ডিগ্রি প্রদান করে একই খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার পিজি হাসাপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের চারুশিল্পের সাধকÑএই মহান শিল্পী।
শেষকথা
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আজীবন চিত্রচর্চা করে গেছেন। এদেশের মানুষের মাঝে শিল্পের সৌন্দর্যবোধ চেতনা উজ্জীবিত করতে দেশে চারুশিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করেছেন। গ্রাম-বাংলার লোকায়েত কারুশিল্পীদের জন্য সোনার গাঁ’য় লোকশিল্প জাদুঘর এবং ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা জীবতৎকালে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই সব ইনস্টিউিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের জনগণের মধ্যে যেমন মানবতাবোধ, জাতীয় ঐতিহ্য সংগ্রহ, শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানবৃদ্ধি হয়েছে অপর দিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর ব্যাপ্তি ঘটেছে। একই সাথে দেশে শিল্পানুরাগী দর্শক ও ক্রেতা সৃষ্টি করে চারুকলার শিক্ষাক্রমকে সমৃদ্ধ করে তথা স্বকীয় চিন্তাচেতনা, ¯^দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখে গেছেন জয়নুল আবেদিন।

প্রবন্ধকার
প্রফেসর ড. হীরা সোবাহান
চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগ
চারুকলা অনুষদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইাল : ০১৭১৬৩৮১৫৩৪

তথ্যসংকেত

১ আবদুল মতিন, জয়নুল আবেদিন (ঢাকা : আহ্মদ পাবলিশিং হাউজ, ১৯৯৭), পৃ. ৭।
২ প্রাগুক্ত, পৃ. ঐ।
৩ আবু তাহের, বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলা এবং তিনজন শিল্পী : জয়নুল আবেদিন, এস, এম সুলতান ও রশিদ চৌধুরী (ঢাকা: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি,
২০০৮), পৃ. ৩১।
৪ মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, “সান্নিধ্যের স্মৃতি” দৈনিক বাংলা (ঢাকা : ৬ জুন, ১৯৯৬), পৃ. ৫।
৫ আবু তাহের, বাংলদেশের আধুনিক চিত্রকলা এবং তিনজন শিল্পী : জয়নুল আবেদিন, এস. এম. সুলতান ও রশিদ চৌধুরী, পৃ.৩২।
৬ হাশেম খান, মানুষ আবেদিন শিল্পী জয়নুল আবেদিন (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৩৯৯ বাং), পৃ. ৮১-৮৩।
৭ ফয়েজুল আজিম, বাংলাদেশের শিল্পকলার আদিপর্ব ও ঔপনিবেশিক প্রভাব (ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ২০০০), পৃ. ৮৭।